উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইরফান সাদিক। অথচ স্বপ্ন পূরণের আগেই র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে নিভে গেছে তার জীবনপ্রদীপ। অমানবিক ও পৈশাচিক-এ ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মারধরের ভিডিও পরিবারের হাতে আসার পর বেরিয়ে এসেছে র্যাগিংয়ের নামে নির্মম নির্যাতনের গা শিউরে ওঠা কাহিনী। সোমবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইরফানের লাশ গ্রহণ করেন স্বজনরা।
পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুর আগে ইরফানের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। দলবেঁধে নির্যাতনে অংশ নেয় সহপাঠীরা। অথচ নির্যাতনের পুরো ঘটনা চেপে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারাও কোনো ব্যবস্থা নেননি। ইরফানের বাবার দাবি ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী তার সহপাঠীরা।
জানা যায়, এক বছর আগে মালয়েশিয়ার সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পড়তে যান ইরফান সাদিক। শুরু থেকে র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছিলেন ইরফান। নির্যাতনকালে তার মাথার চুলও কেটে দেওয়া হয়। ইরফানের বোনের অভিযোগ, সহপাঠীরা তার ভাইয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। ভিডিওতে সে বারবার বাঁচার আকুতি জানায়। আরেক স্বজন জানান, ইরফানকে শুধু নির্যাতন নয়, তার কাছ থেকে টাকাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তার কাছ থেকে বেশ কয়েকজন সহপাঠী টাকা ধারও নেয়। তাদের কাছে টাকা চাইতে গেলে গণপিটুনির শিকার হতে হয়। এ অবস্থায় ইরফান একদিন মোবাইল ফোনে ভিডিও কল করে শুরুতেই বলেন, "আঙ্কেল আমাকে বাঁচান। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে নিয়ে যান।"
নির্যাতনের এই অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যান দায়িত্বশীলরা। তারা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, ঘটনা তদন্ত করেও দেখেনি।
ইরফানের ফুপাতো ভাই মারজুক আহমেদের অভিযোগ, ‘ইরফানের মৃত্যুর পর র্যাগিংয়ে নির্যাতনের ভিডিওসহ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দূতাবাস থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি। ই-মেইলেরও কোনো জবাব দেয়নি। মালয়েশিয়া পুলিশের তরফ থেকেও কোনো সদুত্তর দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যারা এই কেসটা সরাসরি হ্যান্ডেল করেছেন তাদের কাছ থেকেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।’
ইরফানের ওপর নির্যাতনের যে ভিডিও ফুটেজ পরিবারের হাতে এসেছে তাতে দেখা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার সারওয়াক রাজ্যের কুচিংয়ে জালান গম্বিরের ভাসমান মসজিদের বারান্দায় ইরফানকে বিবস্ত্র করে চলে র্যাগিং। এ সময় নির্দয় নির্যাতন থেকে বাঁচতে করুণ আর্তি জানান ইরফান। হাউমাউ করে কেঁদে আকুতি জানান। কিন্তু মন গলেনি নির্যাতনকারীদের। এ সময় ইরফানকে বলতে শোনা যায়, ‘ইয়া আল্লাহ হেল্প মি। অল দ্য চাইনিজ আর রেসিস্ট।’
পরিবারের ধারণা নির্যাতনে চাইনিজ সহপাঠীরাও অংশ নেয়। ১৮ সেপ্টেম্বরই নির্যাতনের স্পটের ৩ মিটারের মধ্যেই পাওয়া যায় ইরফানের লাশ। কয়েক ঘণ্টা পর সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পরিবারকে জানায়, পানিতে ডুবে ইরফান মারা গেছে। মারা যাওয়ার আট দিন পর সোমবার দেশে পৌঁছে লাশ। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশ এলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অবতারণা হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। পুরো হ্যাঙ্গার গেট এলাকায় নেমে আসে শোকের আবহ। সেখান থেকে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর মগবাজারের বাসায়।
পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতনে সবসময় নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশি দুই সহপাঠী। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিদেশি শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ইরফানের পরিবারের সদস্যরা।